• মুখবন্ধ
  • ওঁ
    উশন্তস্ত্বা নি ধীমহ্যুশন্তঃ সমিধীমহি।
    উশন্নু শত আবহ পিতৄন্ হবিষে অত্তবে।।
    ওঁ
    আয়ান্ত নঃ পিতরঃ সৌম্যাসো
    অগ্নিস্বাত্তা পথিভির্দেবযানৈঃ
    অস্মিন্ যজ্ঞে স্বধয়া মদন্তোহ
    ধিব্রুবন্ত তে অবন্ত্বস্মান্। ধিব্রুবস্তুতে অবস্তুমান্?
    পিতৃগণচরণপ্রসাদাৎ 'ভট্টপল্লীবাশিষ্ঠবংশপরিচয়’ গ্রন্থ লিখিত হইল। ইহা আমাদিগের ইতিহাস ও ধর্ম্মগ্রন্থ। আজ প্রায় তিনশত বৎসর অতীত হইয়া গিয়াছে এই বংশ ভাটপাড়ায় অবস্থিত। বংশ প্রাচীন হইয়াছে, ধারা অনেক দূর নামিয়াছে, মুখে-মুখে সব সংবাদ রাখা কঠিন হইয়া পড়িয়াছে, আর লিপিবদ্ধ করিয়া না রাখিলে চলে না, তাই ইহা লিখিত হইল। ইহা স্থূল উদ্দেশ্য। সূক্ষ্ম অভিসন্ধিও আছে। কাল যখন কোথা হইতে কত কি আনিয়া বর্ত্তমানকে অতীতের নিভৃত গহ্বরে ডুবাইয়া দেয়, তখন তাহার খননের আবশ্যক হয়, খুঁড়িতে-খুঁড়িতে অতীতের প্রথম অবস্থাটি জানিতে পারা যায়। তাহাতে আনন্দ আছে। এই যে আজিকার মৃত্তিকাস্তূপ উহা এক সময়ে সমৃদ্ধ নগর ছিল ইহা জানিতে পারিলে সেই মৃত্তিকাস্তূপের বিশিষ্ট একটা আদর হয়। এইতো সাধারণ ভাব ইঁহার ভিতর একটা আসাধরণত্ব আছে। মানবসমাজ লইয়া যখন এই উদ্ঘাটন কার্য্য হইতে থাকে, তখনই ইঁহার আসাধরণত্ব বুঝা যায়। কথা এই, সকল বস্তুরই যেমন বর্ত্তমান অবস্থা অতীত হয়, মানব সমাজের উপরও সেই একই নিয়ম। তবে মানবের একটি বোধ আছে, অপরের নাই। মানব আপনার সমাজের অতীত উদ্ঘাটন করিতে জাইলে বুঝিতে পারে আমরা এই ছিলাম, এই হইয়াছি। এই ‘এইথাকা’ ও ‘এই হওয়া’ যখন উচ্চস্তর হইতে নিম্নস্তরে নামার বিষয়ীভূত হয় তখন মানবসমাজে ভারি একটা বিষাদের ছায়া পড়ে। সারা ভারতে এখন সেই ছায়া। অনেকে বলে আমাদের ইতিহাস নাই। আবার অনেকে বলে আছে। আমি শেষ দলের লোক। বেদ, উপনিষদ্, ব্রাহ্মণ, রামায়ণ, মহাভারত সংহিতা, পুরাণ, কাব্য, ব্যাকরণ প্রভৃতি আমাদের ইতিহাস। তবে উহা হইতে তথ্য বাহির করিতে হয়। “যাবানর্থ উদপানে সর্ব্বতঃ সম্পলুতোদকে তাবান্ সর্ব্বেষু বেদেষু ব্রাহ্মণস্য বিজানতঃ”-র আবশ্যকীয় তথ্য উহা হইতে সংগ্রহ করিতে হয়। এই তথ্য অনুসন্ধান করিয়া যদি আমরা আমাদের ইতিহাস পর্য্যালোচনা করি আমরা জানিতে পারি আমরা কি ছিলাম, কি হইয়াছি। এতো গেল একটা বড় কথা, সারা ভারতের কথা। এখন আমাদের কথা হউক। আমরা বাশিষ্ঠ, সেই ঋষি বশিষ্ঠের সন্তান। বৈদিক যুগ হইতে পৌরাণিক যুগ পর্য্যন্ত বশিষ্ঠের কথা নানাভাবে নানাগ্রন্থে রহিয়াছে। কি উজ্জ্বল ঋষি! সপ্তর্ষিমণ্ডলে তাঁহার স্থান! তাঁহারই পত্নি অরুন্ধতী! তাঁহারই বংশে বেদব্যাস! এক কথায় ভারতের সনাতনধর্ম্মের তিনিই প্রতিষ্ঠাতা। আমরা যখন মনে করি আমাদের ধমনীতে তাহার সেই ঋষিরক্ত প্রবাহিত, মন আনন্দে নাচিয়া উঠে কিন্তু সঙ্গে-সঙ্গে চক্ষে অন্ধকার দেখি হায়! আমরা কে কি হইয়া গিয়াছি। এ শুধু বাশিষ্ঠের অবস্থা নহে, সকল ঋষিসন্তান ব্রাহ্মণগণের।
    এখন আত্মসন্তোষ এই কালের সহিত যাইতে হইবে, হইবেই হইবে, বাধা দিবার সাধ্য নাই। বাধা দিবার সাধ্য নাই কিন্তু একটা সাধ্য আছে, তাহা/যাহা ভাসিয়া যাইতে-যাইতে অতীতের দিকে ফিরিয়া দেখা। দেখায় লাভ আত্মতত্ব উদ্ঘাটন, তাতে লাভ আপনাকে আপনি চেনা। আপনাকে আপনি চিনিয়া যদি সংসারে ভাসিতে থাক, সময়ে উঠিবার চেষ্টা করিতে পারিবে। ইঁহারই নাম আত্মজ্ঞান। ইতিহাসের সূক্ষ্ম বিজ্ঞান এই। আমাদেরও এই বংশেতিহাস লেখার ইহাই সূক্ষ্ম অভিসন্ধি। এই গ্রন্থ পাঠ করিয়া বংশের একজনও যদি আত্মজ্ঞান লাভ করে শ্রম সার্থক হইবে।
    গত সন ১৩৩১ সালে বংশের কি এক পুণ্যফলে বংশের মূলপুরুষ, সিদ্ধ মহাপুরুষ শ্রী শ্রী ৺নারায়ণঠাকুরের আবির্ভাব তিথি শুক্লা মাঘী সপ্তমী, ইহা স্বপ্নলব্ধ বলিয়া উদ্ঘোষিত ইয় ও তদ্দিনে উৎসব ও নারায়ণ ঠাকুরের স্মৃতি রক্ষার্থে “নারায়ণস্মৃতিসমিতি” নামে সমিতি স্থাপিত হয়। বাশিষ্ঠেরা সকলেই উহাতে আনন্দ সহকারে যোগদান করেন, বংশের শিষ্য শ্রীমান্ যোগীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় প্রভৃতি সভায় উপস্থিত হইয়া বিশেষ সহানুভূতি দেখান। এইরূপে সমুদ্ভূত নারায়ণস্মৃতিসমিতি নারায়ণ ঠাকুরের স্মৃতিরক্ষাকল্পে বংশপরিচায়ক একখানি গ্রন্থ প্রকাশের আবশ্যকতা মনে করেন। গ্রন্থে মাত্র স্বর্গগত মহাত্মাগণের যথাসস্তব কিছু কিছু পরিচয় ও মূলপুরুষ হইতে বর্ত্তমান পুরুষগণ পর্য্যন্ত বিস্তৃত বংশবল্লী থাকিবে। এবং ইহাও স্থিরীকৃত হয় যে এই গ্রন্থের সঙ্গে বংশের অন্যতম প্রথম ও প্রধান শিষ্য ভাটপাড়ার আদিম ভূস্বামী হালদার বংশের সংক্ষিপ্ত অতীত ইতিহাস ও মূলপুরুষ হইতে বর্ত্তমান পুরুষগণ পর্য্যন্ত বংশবল্লী সন্নিবেশিত হইয়া উভয় বংশের পবিত্র সম্বন্ধ অঙ্গাঙ্গীভাবে একীভূত করিয়া চিরস্মরণীয় করা হইবে। ভাটপাড়ার অপরাপর শিশ্যগণেরাও যিনি-যিনি তাহাদের বংশবল্লী দিবেন তাহাও ইহাতে সন্নিবন্ধ হইবে। এই সংকল্পের সঙ্গে-সঙ্গেই ইঁহার সঙ্কলনভার আমার সর্ব্বকালমিত্র নারায়ণস্মৃতিসমিতির অন্যতর সম্পাদক পণ্ডিতবর শ্রীযুক্ত কমলকৃষ্ণ স্মৃতিতীর্থ গ্রহণ করিলেন। তাঁহার অনুসন্ধান, তাঁহার সংগ্রহ, তাহার অদম্য উৎসাহ পূর্ব্ব হইতেই আমাদের জানা ছিল, সুতরাং কথায় ও কাজে এক হইতে বিলম্ব হইল ন। আজ যে এই প্রায় দ্বিশতাধিক পিতৃলোকগত মহাত্মাগণের পরিচয় একাধারে পাইয়া অতীতকে প্রত্যক্ষ করিতেছি ইহা কেবল ঐ আমার বন্ধুবরেরই যত্নফল। তিনি কোথায় ঘটককারিকা, কোথায় অন্যান্য গ্রন্থ, এই সব তন্ন-তন্ন করিয়াছেন। পিতৃগণ তাঁহার প্রতি প্রসন্ন হউন/হউক। হালদার শিষ্যগণের পরিচয় ও বংশবল্লী চৌবাড়ীর শ্রীমান্‌ ভববিভূতি বিদ্যাভূষণ এম্‌.এ.র সাহায্যে তাঁহারা, আপনারাই সরবরাহ করিয়াছেন। রায়, মুখোপাধ্যায় ও বন্দ্যোপাধ্যায় শিয্যাদিগের পরিচয় ও বংশবল্লী তাঁহারা নিজে-নিজেই লিখিয়া দিয়েছেন। আমাদিগের বংশবল্লী হইয়াছে স্বতন্ত্র-স্বতন্ত্র ৬ খানি। রমাবল্লভের ধারার ১- পাঁচ, বীরেশ্বরের ধারার বড়, মেজো, চতুর্থ, ষষ্ঠ ও সপ্তম - এই পাঁচ ছেলের পাঁচ ধারার ৫ পাঁচ। একখানি বংশবল্লীতে এতগুলি ধারার সমাবেশ করা অসুবিধা বোধে ঐরূপ করিতে হইয়াছে। আমাদের এই কার্য্যে পাঁচবাড়ীর শ্রীমান্‌ কান্তিচন্দ্র স্মৃতিতীর্থ, টোলের বাড়ীর শ্রীমান্‌ হরিপদ বিদ্যারত্ন (এম্‌.এ.), চৌবাড়ীর শ্রীমান্‌ বনমালী জ্যোতীরত্ন ও ছোট ঠাকুরের বা সাতবাড়ীর শ্রীমান্‌ রামরতন ঠাকুর (এম্‌.এ.) যথেষ্ট সাহায্য করিয়াছেন। পিতৃগণ ইহাদের সকলের প্রতিই প্রসন্ন হউন। আমাদের এই গ্রন্থ যখন সঙ্কলিত হইতেছে তখন বাঁকুড়া, বিষ্ণুপুর-শ্যামপুর-নিবাসী, ২৪ পরগণা ইছাপুর-নবাবগঞ্জ কৃতাধিষ্ঠান, অধুনা কাশীবাসী পণ্ডিতপ্রবর বাশিষ্ঠ শ্রীযুক্ত রামগোপাল স্মৃতিভূষণ গোস্বামী মহাশয় তাঁহার “কাশীবাস” বলিয়া এক গ্রন্থ প্রকাশ করেন ও উহা ভাটপাড়ায় পাঠাইয়া দেন। তাঁহার নিজ বিবরণেই পরিপূর্ণ উক্ত পুস্তকে আমাদেরই এই বশিষ্ঠ বংশের যৎকিঞ্চিৎ পরিচয় দেওয়া আছে। তিনি নিজে বশিষ্ঠগোত্রজ ও আমাদেরই আদিপুরুষ যে গদাধর, তাঁহার প্রথম পুত্র যে বিষ্ণু, তাঁহারই বংশধর। তিনি গদাধরের ২য় পুত্র যে জনার্দ্দন, যাঁহার ধারা আমরা এই ভট্টপল্লীর, আঁড়িয়াদহের, কাটালপাড়ার ও হালিসহরের বাশিষ্ঠ, আমাদের পরিচয় সম্যগ্, অবগত না থাকায় ও যথাযথ অনুসনন্ধান না করায় আমাদের সংবাদ তাঁহার গ্রন্থে বড়ই অসম্পূর্ণ ও স্থানে-স্থানে ভ্রান্তিপূর্ণ হইয়া গিয়াছে। হউক, তথাপি তাঁহার এই প্রথম উদ্যম প্রশংসনীয় এবং আমাদের যখন এখন এই গ্রন্থ বাহির হইল, তখন ভাটপাড়ার বাশিষ্ঠদের সংবাদের জন্য কাহারও আর কোন ভুল থাকিবেনা, গোস্বামী মহাশয়েরও ভবিষ্যতে ইহা উপকারে আসিবে। সে যাহাই হউক, এখন গোস্বামী মহাশয় তাঁহার গ্রন্থস্থ একটি বিষয়ের জন্য বড়ই ধন্যবাদার্হ হইয়াছেন। তিনি গদাধর ঠাকুরের মূল অনুসন্ধান ফল লিপিবদ্ধ করিয়া গিয়াছেন। উহা কান্যকুব্জের অন্তর্গত মার্জ্জনী নামক গ্রাম এবং গঙ্গাতীরে অবস্থিত। তিনি তথায় এখন মিশ্র উপাধিধারী অনেক বশিষ্ঠগোত্রীয় ব্রাহ্মণ দেখিয়া আসিয়াছেন। এ সংবাদ বড় আনন্দের এবং ইহা করিয়া স্মৃতিভূষণ গোস্বামী মহাশয় আন্তরিকই একটি কাজ করিয়াছেন। তবে একটি বিষয় এখনও আমাদের জানিতে বাকী রহিল, স্মৃতিভূষণ মহাশয়ের গ্রন্থে উহা পাইলাম না। উহা প্রবর। আমাদের যে এই তিন প্রবর বশিষ্ঠ, পরাশর, নৈয়ধ্রুব, এই প্রবরই ঐ মার্জ্জনী গ্রামভূক্ত বাশিষ্ঠদিগের কি না তাহা এখনও জানিবার বিষয় রহিল। ভরসা করি আমাদের মধ্যে কেহ ইহা কোন সময়ে পূরণ করিবেন। এইবার হে আমার ভক্তি শ্রদ্ধা স্নেহভাজন বংশীয়গণ! ও আশীর্ভাজন শিষ্যগণ! আমাদের এই স্মৃতিপ্রতিমার দিকে একবার ফিরিয়া চাহন। আমাদের এই প্রতিমা পিতৃগণের ভূষণে বিভূষিত করিয়া আপনাদের সমক্ষে উপস্থাপিত করিয়াছি। দেখুন কি ব্রহ্মজ্ঞতা, কি শাস্ত্রজ্ঞতা, কি ধর্ম্মনিষ্ঠা, কি আচার, কি দান, কি স্নেহ, কি ভক্তি, কি উদারতা, কি উপেক্ষা, কি সরলতা, কি মধুরতা, কি তেজস্বিতা, প্রভৃতি পিতৃগণের বিভূষণ আমাদের এই স্মৃতিপ্রতিমায় রহিয়াছে। আসুন ঐ সমবেত গুণের ঔজ্জ্বল্যে উজ্জ্বল এই প্রতিমা আমরা আমাদের হৃদয় রূপ মন্দিরে মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত করিয়া রাগদ্বেষ ভুলি ও মিলিত হই। পিতৃগণ আশীর্ব্বাদ করিবেন। আসুন আমরা সমস্বরে করজোড়ে বলি :--
    পিতৄন্ নমস্যে দিবি যেচ মূর্ত্তাঃ
    স্বধাভূজঃ কাম্যফলাভিসন্ধৌ।
    প্রদানশক্তাঃ সকলেপ্সিতানাং
    বিমুক্তিদা যেহনভিসংহিতেষু।।
    উপসংহারে বংশীয়গণ ও শিষ্যাগণ প্রতি নিবেদন যে এই গ্রন্থমুদ্রণ কার্য্যে যথেষ্ঠ ব্যয় হইয়াছে, সূক্ষ্ম হিসাব কার্য্যেশেষে নারায়ণস্মৃতিসমিতির নিকট দেওয়া হইবে। মোটামুটি ২৫০ শত টাকা ব্যয় ধরা হইছে। তন্মধ্যে শ্রীমান্ অংশু প্রকাশ হালদার, শ্রীমান্‌ অব্জপ্রকাশ হালদার ও তাঁহাদের ভ্রাতৃগণ ৫০/- টাকা সাহায্য করিয়া যথেষ্ট ও যোগ্য সহানুভূতি দেখাইয়াছেন, বংশীয়গণের নিকট আজ পর্য্যন্ত একশতের কিঞ্চদাধিক টাকা পাওয়া গিয়াছে। ভরসা করি বাকি ব্যয় নারায়ণস্মৃতিসমিতির সদস্যগণ পূরণ করিবেন। পরিশেষে বক্তব্য স্বর্গতগণের পরিচয়ে অনেক স্থানে অনভিজ্ঞতা জন্য ভ্রমপ্রমাদ রহিয়া গেল, এক্ষেত্রে তাহা মার্জ্জনা করিয়া ২য় সংস্করণের সময় বংশীয়গণ আমাদিগকে যথাযথ উপকরণ সরবরাহ করিয়া সাহায্য করিবেন ইহাই প্রার্থনা।
    ওঁ তৎসৎ
    সুর্য্যকুমারং পিতরং নমামি ভক্ত্যা নীলমণেঃ পুত্রম্‌।
    ...স প্রসীদতু পিতা মে নারায়ণসন্ততিঃ সততম্‌।।
    \begin{flushright} ইতি
    নারায়ণস্মৃতিসমিতির অন্যতর সম্পাদক
    বাশিষ্ঠ – শ্রীবিনোদবিহারিবিদ্যাবিনোদ। \end{flushright} \rotatebox[origin=c]{90}{\includegraphics[width=18cm]{Bhatpara Pandits.jpg}}